যেই মুহূর্তে এই লেখাটি পড়ছেন, ঠিক তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ৪০০০ নক্ষত্রের জন্ম হবে, আমাদের সূর্য ৬০০ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন নির্গত করবে, ৩০টি নক্ষত্র মৃত্যুবরণ করবে এবং এই মহাবিশ্ব ১৪.৮ কিলোমিটার প্রসারিত হবে। শুধু তা-ই নয়। এরমকম আরো অসংখ্য ঘটনা ঘটবে এই পুরো ব্রম্মাণ্ড জুড়ে ।
এই মহাবিশ্বে মানুষ টিকে থাকতে পারবে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি অপরিবর্তনীয় শক্তির উৎস থাকছে। আমাদের ক্ষেত্রে এই শক্তির উৎসটি হচ্ছে সূর্য। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যবশতঃ এই সূর্যেরও একটি জীবনকাল আছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সেটি মানুষের জন্যে কোনো চিন্তার বিষয় নয়। কেননা মহাজাগতিক সময় স্কেলে হিসাব করলে তা ঘটতে এখনো বিলিয়ন-বিলিয়ন বছর সময় লেগে যাবে। কিন্তু এ তো গেলো মহাবিশ্বের সহজাত প্রবৃত্তির কথা। এ ছাড়াও কিছু মহাজাগতিক হুমকি রয়েছে যা কিনা সময়ের খুব আগেই মানবজাতিকে নিঃশ্বেস করে দিতে পারে।
আমরা জানি আমাদের মহাবিশ্বে কোটি কোটি নক্ষত্র রয়েছে। ধরে নেয়া যাক আমাদের আশেপাশের কয়েক মিলিয়ন আলোকবর্ষের মধ্যে যতগুলো গ্যালাক্সি রয়েছে তার মধ্যে যতগুলো নক্ষত্র আছে( সংখ্যাটি অসীম ) তাদের থেকে উৎপন্ন শক্তিকে এক জায়গায় যদি কেন্দ্রীভূত করা যায় এবং সেটি যদি একটি কাল্পনিক পিস্তল দ্বারা নিক্ষেপ করা হয় তাহলে তার দ্বারা সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের পরিমানটি একটু ভেবে দেখুন।
ঠিক এরকমই একটি ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে চলছে মহাকাশে। এর নাম ‘গামা রে বার্স্ট’/ ‘Gamma Ray Burst’ বা সংক্ষেপে ‘জিআরবি’। গামা রে বার্স্ট এর কারণ জানতে হলে আগে বুঝতে হবে গামা রে কি।
গামা-রে কি?
গামা রে হচ্ছে একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ওয়েভ যা কিনা দৃশ্যমান আলোর উচ্চতর শক্তি বহন করে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে আলো দেখি তা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ওয়েভের খুবই ক্ষুদ্র এবং নিম্নতর একটি অংশ।
এই নিম্নতর তরঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে রেডিওয়েভ এবং ইনফ্রারেড। উচ্চতর পর্যায়ে রয়েছে এক্স- রে,অতিবেগুনি রশ্নি এবং এ তরঙ্গ যখন অসীম শক্তি লাভ করে তখন তা গামা রে তে পরিণত হয়। বলা যেতে পারে, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ওয়েভের খুবই বিধ্বংসী রূপ হচ্ছে গামা রে। এবং এই গামা রে প্রতিনিয়তই মহাকাশে দৃশ্যমান। আমাদের পৃথিবীর ওজোন স্তর এই গামা রে গুলোর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যদি বায়ুমণ্ডল গামা রে কে বাধা দিতেই পারে তাহলে এই গামা রে কিংবা গামা রে বার্স্ট কিভাবে আবিষ্কৃত হলো?
৮০’র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইউএসএর মধ্যেকার কোল্ড ওয়ারের সময় ইউএসএ মহাকাশে কিছু গোয়েন্দা স্যাটেলাইট পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়নের নিক্ষেপকৃত বোমা সনাক্ত করার জন্যে।
স্যাটেলাইট গুলো কোনো বোমার অস্তিত্ত্ব পায়নি, কিন্তু মহাকাশে কিছু রহস্যময় বিস্ফোরণ দেখতে পায়। এই বিস্ফোরণ গুলোর উৎপত্তি সম্পর্কে বিশ বছর ধরে ধোঁয়াশা ছিল কিন্তু একসময় বিজ্ঞানীরা একটি গামা রে বিস্ফোরণের উৎপত্তি খুঁজে পান আমাদের গ্যালাক্সি থেকে ৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে একটি গ্যালাক্সি তে। এতো দূরের একটি বিস্ফোরণ যদি দেখা যেতে পারে তাহলে বুঝাই যাচ্ছে এর শক্তি কতটা অসীম। আমাদের সূর্যের সাথে গামা রে এর তুলনা করে দেখা যায় সূর্য ১০ বিলিয়ন বছর ধরে যে পরিমান শক্তি নির্গত করে, একটি গামা রে তার চাইতেও অনেক অনেক গুন বেশি শক্তি নির্গত করে মাত্র এক সেকেন্ডে !
এখন প্রশ্ন হচ্ছে গামা রে কিংবা গামা রে বার্স্টের উৎপত্তি কি? এখানে চলে আসে ব্ল্যাকহোলের প্রসঙ্গ।
আমরা জানি একটি নক্ষত্র সুপারনোভার মাধ্যমে যখন তার নিজের জীবনের অন্ত ঘটায় তখন একটি ব্ল্যাকহোলের জন্ম হয়। সেই সুপারনোভা বা মহাবিস্ফোরণই হচ্ছে গামা রে এর উৎপত্তি।
শুধু তা-ই নয়, একটি ব্ল্যাকহোল জন্মের পরেও গামা রে উৎপন্ন করতে পারে। ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘিরে থাকে তার প্যারেন্ট স্টারের যাবতীয় গ্যাস যা কিনা একটি ঘূর্ণায়মান ডিস্কের আকার নিয়ে থাকে। এই ঘূর্ণায়মান ডিস্কটি আলোর গতিতে ঘূর্ণায়মান যা কিনা একটি চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরী করে। এর থেকে সৃষ্ট শক্তি কণাগুলো লেজারের মতো করে আলোর গতিতে নির্গত হয়।
সুতরাং এটি কোনো সাধারণ বিস্ফোরণ নয়। একে একটি মহাজাগতিক লেজার গানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এ যাবৎ যত গুলো গামা রে বিস্ফোরণ আবিষ্কার হয়েছে তার সবই আমাদের গ্যালাক্সি অর্থাৎ মিল্কিওয়ের বাইরে। কিন্তু আমাদের গ্যালাক্সিতে যদি এরকম কোনো গামা রে বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে তা আমাদের জন্যে খুবই উদ্বেগের কারণ হতে পারে। আমাদের গ্যালাক্সিতে সৃষ্ট কোনো গামা রে বার্স্ট পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ ধ্বংস করে দিতে পারে। এমনকি আমাদের আশেপাশে ৪ হাজার আলোকবর্ষের মধ্যে যদি কোনো গামা রে বার্স্ট হয় তা পৃথিবীকে পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। ধারণা করা হয় ৪৫০ মিলিয়ন বছর আগে অর্ডোভিশিয়ান এক্সটিঙ্কশনের জন্য দায়ী একটি গামা রে বার্স্ট যা কিনা পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণীকে নির্মূল করেছিল। এবং আরো ধারণা করা হয় গামা রে বার্স্টের জন্যই হয়তো অন্য কোনো গ্রহ বা গ্যালাক্সিতে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। পরীক্ষায় দেখা গেছে এই মহাবিশ্বের মাত্র ১০ শতাংশ গ্যালাক্সি প্রাণের অস্তিত্বের জন্য অনুকূল। যা কিনা খুবই নগন্য।